পাকিস্তান জন্মের পর বাঙালি মনে প্রথম খটকাটা শুরু হয় বহুল ব্যবহৃত মানি অর্ডার বা টাকা লেনদেনের রশিদটা দেখে। অবাক বিস্ময়ে তারা দেখল, রশিদটা লেখা উর্দু ভাষায়, বাংলায় নয়। এটাই প্রথম বাঙালি মননে আঘাত! তাঁদের হৃদয় থেকে উঠে আসেঃ ‘না, মানি না। মানব না।’ আসলে মানুষ যখন পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাঁদের একটা স্বপ্ন ছিল, একটা সামগ্রিক আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু তখনকার পাকিস্তানের বাস্তবতায় এর রেশমাত্রও দেখা যাচ্ছিল না। ফলতঃ একটা জনরোষ বেশ তীব্র বেগেই তৈরি হচ্ছিল। এরই ফলাফল বায়ান্নর একুশ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবিই এ দিনের প্রধান স্লোগান, সন্দেহ নেই। তবে এই স্লোগানের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল অধিকারের প্রশ্ন। রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক অধিকার, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার! এই অধিকারের সাথে যে বঞ্চনা জড়িত ছিল, আশাভঙ্গের যে বেদনা পরতে পরতে প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেটা ছিল আরও তীব্র। ১৯৪৮ এর মার্চ থেকে বায়ান্ন’র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে ইতিহাস, সে ইতিহাসই এর সবচেয়ে বড় সাক্ষী।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ভাষা ও সংস্কৃতিকে ঘিরে সামাজিক এমন একটি শক্ত বলয় গড়ে উঠেছিল যেটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল “বাংলা’ বিরোধী একটা মনোভাব। সরকারি উদ্যোগে আরবি হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা হয়েছিল, আরেকদল বাংলায় উর্দু-আরবি-ফারসি মিলিয়ে একটা সংকর জাতীয় ভাষা উদ্ভাবনের চেষ্টাও করেছে। সংস্কৃতকে ইঙ্গিত করে এমনও প্রচার করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বাংলা হিন্দুয়ানী ধরণের ভাষা; পাকিস্তানের মঙ্গল চাইলে, এই ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে আবেগ অনুভূতি কমাতেই হবে। তবে আপামর জনসাধারনের কাছে এ ধরনের প্রচারনা তেমন পাত্তাই পায় নি। বরং রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি তাঁদের চিন্তাভাবনায় বেশ গুরুত্বের সাথেই জায়গা করে নিচ্ছিল। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটিকে শাসকগোষ্ঠী আস্তে আস্তে জটিল করে তুলছিল। ফলে, জনগনের মধ্যেও এই ধারনা প্রোথিত হচ্ছিল যে, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রের আয়োজন চলছে। ফলে, ভাষার ব্যাপারে তাঁদের অবস্থান ও প্রতিজ্ঞা আরও দৃঢ়তর হতে থাকে। এরই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। নিজের ভাষাকে যে কোন মূল্যে জিইয়ে রাখার জন্য এমন আত্মোৎসর্গ পৃথিবীতে নেই। এক্ষেত্রে, একটা ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আরবরা যখন মিশর জয় করে, মিশরবাসী তখন কপ্টিক ভাষায় কথা বলত। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর প্রচণ্ড তাড়নায় কপ্টিক ভাষার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়, আরবীই সেই আসন গ্রহণ করে। আজ কিন্তু কপ্টিক ভাষা মৃত। আমাদের ক্ষেত্রেও হয়তো এমনটা ঘটতে পারত; কিন্তু আমাদের বীরেরা সেটা হতে দেয় নি।
একুশ শুধুমাত্র আমাদের শ্রদ্ধা, আবেগ আর ভালবাসার প্রতীকই শুধু নয়; একুশ এক শক্তির আধার, যেখান থেকে আমরা সঞ্চয় করেছি এরপরের প্রত্যেকটি সংগ্রামের রসদ। একুশ এমন এক ঐক্যের সৃষ্টি করেছিল, যার তাৎপর্য প্রচণ্ড গভীর। আমরা যদি ভাষা আন্দোলনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সাংস্কৃতিক কিংবা সামাজিক আন্দোলনের পারস্পরিক সাফল্যের তুলনা করি, তাহলেই দেখব, একুশে ফেব্রুয়ারীর পর থেকেই রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক যে কোন আন্দোলনের সাথে জনগনের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে।
এরপর, স্বাধীনতার সূত্র ধরে আমরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। প্রতি বছর আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে ভাষাশহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার ও শফিউরকে স্মরণ করি। তবে এই আবেগ দিনমেয়াদী কিংবা সপ্তাহ মেয়াদী, বড়জোর মাস মেয়াদী। আমাদের সারা বছরের কর্মকাণ্ডে সেই প্রকাশ তো থাকেই না; বরং, কোন কোন ক্ষেত্রে উল্টোটাও পরিলক্ষিত হয়। ইংরেজিকে প্রয়োজনীয় অবস্থানে রেখেও, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা যেত; তাতে, কিছুটা দায় অন্ততঃ কমত। আমরা যখন দেখি, নিমন্ত্রণপত্র থেকে শুরু করে দোকানপাটের পণ্য বিক্রির তালিকা কিংবা অর্থ লেনদেনের রসিদে পর্যন্ত বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রতিষ্ঠা পায়নি—তখন বাংলা ভাষার অবস্থানগত উৎকর্ষ নিয়ে মনে বেশ বড়সড় প্রশ্নই জাগে। আমি নিজে ইংরেজির শিক্ষক; পেশাগত তাগিদে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়েই আমার নড়াচড়া। কিন্তু নিজের ভাষার প্রশ্নে আমার অবস্থান পরিষ্কার।
এ জাতীয় আলোচনায় প্রায়ই যে বিষয়টা সামনে আসে, সেটা ‘বিশ্বায়ন’। যদি সেটাই হয়, তাহলে দেখেন, ইংরেজির সর্বগ্রাসী প্রভাব সত্ত্বেও কিভাবে চীনা, জাপানি, কোরীয়, থাই, তামিল, তেলেগু, হিন্দি ভাষার মানুষেরা তাঁদের নিজ মাতৃভাষাকে প্রতিনিয়ত আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে, আমরা কেন পারছি না? পারছি না; কারণ, ভাষার কিংবা অনুবাদের রাজনীতির ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে উদাসীন হয়ে পরেছি। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক কিংবা তেজস্বিনী নিরঞ্জনার মত তাত্ত্বিকরা ব্যাপারটিকে দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ধরুন, একটা বাংলা ধ্রুপদী সাহিত্যকে আপনি বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছেন। যখন একটা বাংলা লেখাকে অনুবাদ করতে যাবেন, আপনি নিশ্চয়ই ভাববেন, আপনার পাঠক হবেন ভিনদেশি। তাই আপনি খুব সন্তর্পণে আপনার একেবারে নিজস্ব শব্দগুলি না লিখে পাঠকের বোধগম্য ব্যাখ্যায় তাঁদের শব্দগুলিই ব্যবহার করবেন। এবং সেটাই বেশ স্বাভাবিক। কিন্তু এতে কী হবে, জানেনঃ ধীরে ধীরে বাংলার ঐ একেবারে নিজস্ব শব্দগুলি হারিয়ে যেতে থাকবে। আসলে ভাষাভিত্তিক এই উপনিবেশায়নকে ঠেকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই বাস্তবতায় একটি কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যদি বাংলা ভাষাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে নিয়ে না আসতে পারি, আমাদের ক্ষতটা অন্যদের চেয়ে বেশীই হবে।
একুশের চেতনাকে ধারন করার প্রসঙ্গে বছর দুয়েক আগের দুটি ঘটনা আপনাদের মনে করিয়ে দেই:
১। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি একুশের ব্যানারে ছবি ছাপিয়েছিল ১৯৭১–এ শহীদ বীরশ্রেষ্ঠদের।
২। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগও একই কাজ করেছিল। ভয়ংকর ব্যাপার হল, ঐ বিভাগের শিক্ষক ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবুল কাশেম বলেছিলেন, বিজ্ঞান অনুষদের এ রকম ভুল গ্রহণযোগ্য হলেও কলা অনুষদের এ ধরনের ভুল ক্ষমার অযোগ্য। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা চেতনার একুশ ভুলে যেতেই পারে!
স্যারের এই বক্তব্য আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। খুব কর্কশ শোনালেও, আমার ধারনা, এটাই সম্ভবত আমাদের সার্বিক বাস্তবতা।
সাহিত্য, সংস্কৃতিতেও একুশকে আমি অবহেলিতই বলব। বিনোদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম চলচ্চিত্র ও উপন্যাসে আমাদের ভাষা আন্দোলনের উপস্থিতি দৃষ্টিকটুভাবে কম। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, জহির রায়হানের “জীবন থেকে নেয়া” ও তৌকির আহমেদের “ফাগুন হাওয়া” ছাড়া আর কোন চলচ্চিত্রে ভাষা আন্দোলনের সরব উপস্থিতি নেই। অন্যদিকে, ১৯৬৯ সালে বই আকারে প্রকাশিত হওয়া জহির রায়হানের “আরেক ফাল্গুন” ছাড়া ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক আর কোন উল্লেখযোগ্য উপন্যাস এখনো রচিত হয় নি।
আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, নতুন এক উপদ্রপও দেখা দিয়েছে। সেটা হল, বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এর প্রাধান্য ছড়িয়ে পড়েছে সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, এমনকি সাংবাদিকতায়ও। বাংলার শিক্ষকরা আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবেন, আমাদের প্রধান ধারার শিক্ষার্থীরা প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা পড়ে আসে। তারপরেও, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের বেশ বড় একটি অংশ শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে, লিখতে কিংবা পড়তে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা এই দুর্বলতাকে আর কাটিয়ে উঠতে পারে না। এর নেতিবাচক প্রভাব আমরা কর্মজীবনেও দেখতে থাকি।
এদিকে, ইংরেজি মাধ্যম থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা বাংলায় শোচনীয়ভাবে দুর্বল। তাঁদের অনেকেই ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলে। অনেক নান্দনিক শব্দ থাকার পরেও তাঁরা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা জরুরী নয়।
এক্ষেত্রে এটা মনে রাখা প্রয়োজন, ভাষার সামাজিক ও আঞ্চলিক বৈচিত্র্য থাকবেই। তবে, স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনায় আমাদের প্রমিত বাংলা জানা এবং ব্যবহার করাটাও জরুরী। ভাষার প্রমিতায়ন না থাকলে, ভাষাভিত্তিক স্বেচ্ছচারিতাও বেড়ে যাবে।
আমাদের গৌরবময় একুশ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই আন্তর্জাতিকতার পূর্ণতা আসবে আমাদের জাতীয় উপলব্ধির মধ্য দিয়ে। শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভাষার ব্যাপারেই সব মনোযোগ দিব, তেমনটা হওয়া উচিত না। আমাদের দেশেও কিন্তু অনেকগুলো ভাষা আছে। আমাদেরও জানতে হবে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, হাজং, সাঁওতাল, মনিপুরী সাহিত্যে কী আছে। এই ভাষাগুলো কিন্তু সচল ও জীবন্ত! ওদের বাস্তবতাও স্বীকার করতে হবে।
এই সুযোগে, আরেকটা বিষয় নিয়েও কথা বলতে চাই। সেটা হচ্ছে ‘ভাষা আন্দোলন বিষয়ক বই।’ এ বিষয়ে অবশ্য পাঠ্য বদরুদ্দিন উমরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই “পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি”। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বইটি সম্বন্ধে জানে না কিংবা পড়ে নি, ব্যাপারটি নাজুক; ঠিক গ্রহণযোগ্যও নয়। বইটি কোন না কোনভাবে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। নিদেনপক্ষে, আমরা শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বইটি পড়তে উৎসাহিত করতে পারি। “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সিলেট” শিরনামে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভাষা সৈনিক আজিজ স্যারের (স্যার এখানে উপস্থিত আছেন) একটি বই আছে; এটিও আমাদের পড়া উচিত। অন্ততঃ এরকম একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনে সিলেট কিভাবে কিভাবে যুক্ত হয়েছিল, সেটি জানবার স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা থেকে হলেও।
সর্বোপরি যে অবস্থান থেকে আমার আজকের বক্তব্য শেষ করতে চাই, সেটা হচ্ছেঃ আমরা যারা শিক্ষক, আমাদের দায় সবচেয়ে বেশি। একটা শ্রেণীকক্ষে একজন শিক্ষক অসংখ্য শিক্ষার্থীর উপর আদর্শগত প্রভাব ফেলতে পারেন। আমাদের ভাষাই প্রধানত আমাদের মৌলিকত্ব নির্ণয় করে। আমরা যেন কোনক্রমে নিজেরাই নিজেদের আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি না করি, সেটাই লক্ষ্য রাখতে হবে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে।